
বাইপোলার ডিসঅর্ডার: মেঘনার আলো-ছায়ার জীবন
মেঘনা, একজন প্রতিভাবান স্থপতি, ৩৫ বছর বয়সী এই নারীটির জীবন যেন এক রোলারকোস্টার। বাইরের জগৎ তাকে দেখে একজন সফল, উদ্যমী এবং প্রাণবন্ত মানুষ হিসেবে। কিন্তু মেঘনার ভেতরের জগতে লুকিয়ে আছে এক ভিন্ন কাহিনি – বাইপোলার ডিসঅর্ডারের এক নিরন্তর সংগ্রাম।
মেঘনার জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু সময় আসে, যখন তার ভেতরের শক্তি যেন বাঁধ ভাঙা বন্যার মতো। এই সময়গুলোকে সে নিজেই "আমার আলোর ঝলকানি" বলে ডাকে। এই সময়গুলোতে মেঘনা দিনে মাত্র ২-৩ ঘণ্টা ঘুমায়, অথচ নিজেকে সে অবিশ্বাস্যরকম সতেজ এবং সৃষ্টিশীল অনুভব করে। তার মন নতুন নতুন আইডিয়ায় ভরে যায়, সে একসঙ্গে একাধিক প্রজেক্ট হাতে নেয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে ক্লান্তিহীনভাবে। অফিসের সবাই তার এই কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়। সে খুব দ্রুত কথা বলে, এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে লাফিয়ে চলে যায়। সে সময় তার আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়ে যায় যে, সে নিজেকে অজেয় মনে করে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে সে অনর্গল কথা বলে যায়, দামি রেস্টুরেন্টে হুট করে বিশাল বিল করে ফেলে, এমনকি অনলাইনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে ফেলে। মাঝে মাঝে তার মেজাজ এতটাই খিটখিটে হয়ে যায় যে, সামান্য কারণে সে রেগে যায়, অন্যের কথায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই সময়গুলো তার জন্য যেমন উত্তেজনাপূর্ণ, তেমনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার এক ভয়ও কাজ করে।
কিন্তু হঠাৎ করেই যেন এই "আলোর ঝলকানি" নিভে যায়। তারপর আসে এক গভীর "অন্ধকারের ছায়া" বা বিষণ্ণতার পর্ব। এই সময় মেঘনা বিছানা থেকে উঠতেই পারে না। বাইরের উজ্জ্বল আলো তার চোখে অসহ্য লাগে। অফিসের কাজ, যা কিছুদিন আগেও তার কাছে নেশার মতো ছিল, এখন তা পাহাড়ের মতো মনে হয়। ফোনে কথা বলতেও তার ইচ্ছে করে না, বন্ধুদের সাথে দেখা করা তো দূরের কথা। সারাক্ষণ এক গভীর দুঃখ আর হতাশা তাকে ঘিরে রাখে। ঘুম তার প্রিয় ছিল, কিন্তু এখন হয় সে একেবারেই ঘুমাতে পারে না, নয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুমিয়েও ক্লান্তি কাটে না। খাবার দেখলেই তার গা গুলিয়ে ওঠে, ফলে তার ওজন দ্রুত কমে যেতে থাকে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে নিজেকে মূল্যহীন আর কুৎসিত মনে করে। নিজের জীবনের সবকিছু অর্থহীন মনে হয় এবং মাঝে মাঝে তার মনে হয়, সবকিছু শেষ হয়ে গেলে বুঝি ভালো হতো। এই সময়গুলো এতটাই যন্ত্রণাদায়ক হয় যে, মেঘনা একা একা কাঁদতে থাকে এবং কারো সাথে নিজের অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিতে পারে না।
মেঘনার স্বামী, রায়হান, প্রথমদিকে তার এই হঠাৎ পরিবর্তনগুলো বুঝতে পারতেন না। মেঘনার "আলোর ঝলকানি"র সময় সে আনন্দিত হলেও, যখন "অন্ধকারের ছায়া" নেমে আসতো, তখন রায়হান হতাশ হয়ে পড়তেন। কিন্তু একজন বন্ধুর পরামর্শে তারা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যান। বিশেষজ্ঞ মেঘনার লক্ষণগুলো শুনে তাকে বাইপোলার ডিসঅর্ডার বলে নির্ণয় করেন।
চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর মেঘনার জীবন ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হতে শুরু করে। সে নিয়মিত মুড স্টেবিলাইজার ওষুধ গ্রহণ করে এবং থেরাপিতে অংশ নেয়। থেরাপির মাধ্যমে সে তার মেজাজের পরিবর্তনগুলো চিনতে শেখে এবং সেগুলো মোকাবিলা করার কৌশল আয়ত্ত করে। রায়হানও এখন মেঘনার এই অবস্থা সম্পর্কে অনেক সচেতন এবং তাকে সবরকমভাবে সমর্থন দেন।
মেঘনার জীবন এখনও পুরোপুরি মসৃণ নয়। মাঝে মাঝে ছোটখাটো মেজাজের পরিবর্তন আসে। কিন্তু এখন সে জানে, এটি একটি রোগ, এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মেঘনা এখন শিখেছে যে, এই "আলোর ঝলকানি" এবং "অন্ধকারের ছায়া" তার জীবনের অংশ, কিন্তু এগুলোই তার পুরো পরিচয় নয়।
এই গল্পে মেঘনার মধ্যে বাইপোলার ডিসঅর্ডারের যে বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা পাই:
-
ম্যানিক/হাইপোম্যানিক পর্ব ("আলোর ঝলকানি"):
- অতিরিক্ত শক্তি ও কর্মতৎপরতা: দিনে কম ঘুমিয়েও ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করা।
- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস: নিজেকে অজেয় মনে করা।
- দ্রুত কথা বলা ও চিন্তার গতি: এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে লাফিয়ে যাওয়া।
- বেপরোয়া আচরণ: অতিরিক্ত খরচ করা।
- খিটখিটে মেজাজ: সামান্য কারণে রেগে যাওয়া।
-
বিষণ্ণ পর্ব ("অন্ধকারের ছায়া"):
- গভীর দুঃখ ও হতাশা: মন খারাপ থাকা, কোনো কিছুতে আনন্দ না পাওয়া।
- শক্তির অভাব: বিছানা থেকে উঠতে না পারা, ক্লান্তি।
- ঘুমের সমস্যা: অতিরিক্ত ঘুমানো বা একেবারেই ঘুম না আসা।
- ক্ষুধা ও ওজনের পরিবর্তন: খাবার দেখলে গা গুলানো, ওজন কমা।
- মূল্যহীনতা বা অপরাধবোধ: নিজেকে অযোগ্য মনে করা।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: লোকজনের থেকে দূরে থাকা।
- আত্মহত্যার চিন্তা: (যদিও গল্পে সরাসরি বলা হয়নি, তবে বিষণ্ণতার গভীরতা থেকে এটি বোঝা যায়)।
-
দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা ও চিকিৎসা:
- ওষুধ (মুড স্টেবিলাইজার) এবং থেরাপির মাধ্যমে রোগের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা।
- পরিবারের সমর্থন এবং সচেতনতার গুরুত্ব।
এই গল্পটি বাইপোলার ডিসঅর্ডারের একটি সরল চিত্র। প্রকৃত ঘটনা আরও জটিল হতে পারে এবং প্রতিটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে। মনে রাখবেন, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হলে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।